ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা

মো. জিল্লুর রহমান

২৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৪২ পিএম


ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা

মো. জিল্লুর রহমান


২৪অক্টোবর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্রের জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তীতে লুপ্ত লীগ অব নেশন্সের স্থলাভিষিক্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৯৩টি দেশ জাতিসংঘের সদস্য এবং ভ্যাটিকান সিটি ও ফিলিস্তিন দুইটি পর্যবেক্ষণকারী দেশ । সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সংকট হলো মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংকট। ইসরায়েলকে বৃহৎ শক্তিগুলির একছত্র সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে জাতিসংঘ কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কেউই এই দ্বন্দ্ব মীমাংসা করতে পারছে না। সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। মৃত্যুর খাতায় যুক্ত হচ্ছে বহু অসহায় ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি। কিন্তু এবার হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। হামাসের হঠাৎ জ্বলে ওঠাকে ইসরায়েলের জন্য বিশাল সামরিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক বিপর্যয় বলা যেতে পারে। কারণ তাদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে না। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রতি তাদের নাগরিকদের যে আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, তাতেও ভয়ংকরভাবে ফাটল ধরেছে এবং অনেক ইসরায়েলই ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। আর এ কারণেই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ইহুদিবাদী দখলদার শক্তি ইসরায়েল গাজায় নিরীহ নিরাপদ মানুষের উপর নির্বিচারে বিমান হামলা করে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে এবং সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য যখন ভেঙ্গে পড়ে, তখন যে 'লিগ অব নেশন' গঠিত হয়েছিল, সেই বিশ্ব সংস্থার পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে প্যালেস্টাইন শাসন করার একছত্র 'ম্যান্ডেট' দেয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছিল তখন ব্রিটেন আরব এবং ইহুদী, উভয় পক্ষের কাছেই প্যালেস্টাইন নিয়ে নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটেন এসব প্রতিশ্রুতির কোনটিই রক্ষা করেনি। বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য তখন কার্যত এক গোপন চুক্তির মাধ্যমে দুই বৃহৎ শক্তি ব্রিটেন আর ফ্রান্স ভাগ-বাটোয়োরা করে নিয়েছিল এবং নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখে। প্যালেস্টাইনে তখন থেকেই আরব জাতীয়তাবাদী এবং ইহুদীবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। ইহুদী এবং আরব মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর নাৎসিদের হাতে লাখ লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয় এবং তারপর ইহুদীদের পক্ষ থেকে জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ বাড়তে থাকে। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলটি তখন ফিলিস্তিনি আর ইহুদীদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল। কিন্তু পরদিনই মিশর, জর্দান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। সেটাই ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ইহুদীদের কাছে এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইসরায়েল বা ইহুদীদের দখলে। ফিলিস্তিনের জাতীয় বিপর্যয়ের শুরু সেখান থেকে এবং এটিকেই তারা ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় দিবস হিসেবে পালন করে। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়। ইহুদী বাহিনী তাদেরকে তাদের নিজ বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করে।

 

২০১৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে ঘোষণা দেন, তারা ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরায়েল মধ্যে সম্পাদিত অসলো শান্তি চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য নন, কারণ ইসরায়েল এই চুক্তি মেনে চলেনি। তিনি আরও বলেন, একটি দখলদারি শক্তি হিসেবে এখন সবকিছুর দায়িত্ব ইসরায়েলের ঘাড়েই বর্তাবে। এর কারণ একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিলম্ব, পশ্চিম তীরে ইহুদী বসতি নির্মাণ অব্যাহত রাখা এবং ফিলিস্তিনি ও ইহুদী এলাকার মধ্যে নিরাপত্ত প্রাচীর তৈরি করা- এগুলি শান্তি প্রক্রিয়াকে বেশি জটিল করে ফেলেছে। তাছাড়া, দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত পশ্চিম তীরে ইহুদী বসতি নির্মাণকে অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং ইসরায়েল তার তোয়াক্কা করছে না।

 

১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্যালেস্টাইন ভাগ করার যে পরিকল্পনা অনুমোদন করে, সেখানে একটি আরব এবং একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল আর জেরুসালেম নগরীর জন্য একটি বিশেষ কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়। ইসরায়েল পরিকল্পনাটি মেনে নিয়েছিল, কিন্তু আরবরা প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ এই পরিকল্পনাকে আরবরা দেখছিল তাদের ভূমি কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে। কিন্তু প্যালেস্টাইনের ওপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার মাত্র একদিন আগে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ইহুদীরা ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পরের দিনই ইসরায়েল জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন জানায়, যা এক বছর মধ্যেই গৃহীত হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ১৯২টি দেশের ১৬০টি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য ১৯৪৭ সালে প্যালেস্টাইন বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ কমিটি সুপারিশ করেছিল একটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে "পশ্চিম গ্যালিলি, সামারিয়া এবং জুডেয়ার পার্বত্য অঞ্চল, তবে জেরুসালেম নগরী এবং মিশর সীমান্ত পর্যন্ত ইসডুডের উপকূলীয় সমভূমি এর মধ্যে পড়বে না।" কিন্তু আজকের ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের বিভাজন মূলত নির্ধারিত হয়েছে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতির রেখা বরাবর।

 

ফিলিস্তিনের প্রধান দুটি অধ্যুষিত এলাকা হচ্ছে পশ্চিম তীর বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক (৫,৯৭০ বর্গ কিমি) এবং গাজা ভূখন্ড (৩৬৫ বর্গ কিমি)। পশ্চিম তীর ও গাজা মূলত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান এবং এর মধ্যবর্তী ভারতের অবস্থানের সাথে তুলনীয়। ঠিক তেমনিভাবে পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে বিশাল অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল। এই দুই ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের সবচেয়ে নিকটবর্তী দুটি এলাকার মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক বা পশ্চিম তীরকে এই নামে ডাকা হয় কারণ এটি জর্দান নদী এবং ডেড সী বা মৃত্যু সাগরের পশ্চিম তীরে জেরুসালেম পর্যন্ত এর বিস্তার। ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পুতুল ফিলিস্তিনি সরকার। ধর্মনিরপেক্ষ ফিলিস্তিনি দল ফাতাহ এই ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের মূল শক্তি বা দল। আর গাজার সঙ্গে রয়েছে ইসরায়েলের ৫১ কিমি দীর্ঘ সীমান্ত। মিশরের সঙ্গেও গাজার ৭ কিমি সীমান্ত আছে। গাজার অন্যদিকে ৪০ কিমি দীর্ঘ ভূমধ্যসাগর উপকূল। গাজা ভূখণ্ড এখন হামাস নিয়ন্ত্রণ করে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী জনপ্রিয় দল হামাস। অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে হামাস তাকে স্বীকৃতি দেয় না।

 

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে গেল, তখন ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পশ্চিম তীর এবং গাজায় দানা বাঁধতে থাকে। সেখানে ফিলিস্তিনিরা বিভিন্ন দলে সংগঠিত হয়ে সংগ্রাম শুরু করে। গাজা নিয়ন্ত্রণ করতো মিশর আর পশ্চিম তীর ছিল জর্দানের নিয়ন্ত্রণে। অন্য কিছু আরব দেশেও ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় শিবির তৈরি হয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু আগে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো মিলে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) গঠন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দল ছিল ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী ফাতাহ। পিএলও গঠিত হওয়ার পর এর বাহিনী ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ শুরু করে। প্রথমে তারা হামলা চালায় জর্দান থেকে, এরপর লেবানন থেকে।

 

এরপর ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরায়েল একটি শান্তি চুক্তিতে সই করে যা অসলো শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। পিএলও সহিংসতা এবং সংগ্রাম পথ পরিহার করে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং শান্তির অঙ্গীকার করে। তবে হামাস কখনোই এই চুক্তি মানেনি। চুক্তি অনুসারে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে তাদের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করে। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ইসরায়েল এই প্রতিশ্রুতি কখনোই বাস্তবায়ন করেনি। তারা বরং অধিকৃত এলাকায় ইহুদী বসতি গড়ে তোলে। এই ইসরায়েলি ফিলিস্তিনি শান্তি চুক্তির অধীনেই গঠিত হয়েছিল 'প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি' বা ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি পুতুল সরকার। জেরুসালেম যদিও ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্যতম উৎস, তারপরও এই অসলো শান্তি চুক্তিতে জেরুসালেমের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

 

২০১২ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব ভোটে পাশ হয়। এতে ফিলিস্তিনিদের 'নন মেম্বার অবজারভার স্টেট' বা পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। এর ফলে ফিলিস্তিনিরা তখন থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তারা জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠাগুলোর কাজেও অংশ নিতে পারে। ২০১১ সালে অবশ্য একটি পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের আপত্তির কারণে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু জাতিসংঘের স্বীকৃতি না মিললেও সাধারণ পরিষদের ১৯২ টি দেশের ১৩৪টি দেশ অর্থ্যাৎ এই সংস্থার ৭০ ভাগ সদস্য রাষ্ট্রই ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। ২০১৫ সালের সেপেম্বরে জাতিসংঘ সদর দফরের বাইরে ফিলিস্তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলনেরও স্বীকৃতি মিলে। কিন্তু এগুলো সবই আন্তর্জাতিক মহলের লোক দেখানো নাটক, স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সূদুর পরাহত।

 

গত ৫০ বছর ধরেই ইসরায়েল এসব দখলীকৃত জায়গায় ইহুদী বসতি স্থাপন করছে। ছয় লাখের বেশি ইহুদী এখন এসব এলাকায় বসবাস করছে। ফিলিস্তিনিরা বলছে, আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অবৈধ বসতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়। তবে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক কোন আইন কানুন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে না। কারণ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদীরা ব্যাপক বিদ্বেষ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই ‘জাওনিজম’ বা ইহুদীবাদী আন্দোলনের শুরু। ইহুদীবাদী আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপের ইহুদীরা দলে দলে প্যালেস্টাইনে গিয়ে বসত গড়তে শুরু করে। কিন্তু তাদের এই অভিবাসন স্থানীয় আরব এবং মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। সেসময় আরব এবং মুসলিমরাই ছিল সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

 

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেক কিছু্ই বদলে গেছে। বিশেষ করে আরব এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে অনেক যুদ্ধের পর বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলির চেহারাই পাল্টে গেছে। ইসরায়েল যেহেতু অধিকৃত অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণে, তাই তারা এর ভিত্তিতেই দর কষাকষি করতে চায়। কিন্তু হামাস দাবি করছে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে যে সীমানা ছিল, সেই সীমানার ভিত্তিতেই তাদের রাষ্ট্র হবে। আর পশ্চিম তীরে ইসরায়েল যে অবৈধ বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে, সেটা নিয়ে নীরব লড়াই তো চলছেই। পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস, উভয়েই চায় পূর্ব জেরুসালেম হবে তাদের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী। যদিও ইসরায়েল ১৯৬৭ সাল হতে এটি দখল করে রেখেছে।

 

ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।
ব্রিটেনের উদ্যোগেই ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণা এবং পরবর্তীতে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই ১৯৪৮ সালে মূলত ইহুদিবাদী ইসরায়েলের জন্ম। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ইসরায়েলের খুবই ক্ষমতাধর একটি শক্তিশালী লবি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার, ব্যবসা বাণিজ্য ও মিডিয়া সাম্রাজ্য ইহুদি বলয়ের দখলে এবং এ কারণে সেখানে জনমতও ইসরায়েলের পক্ষে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্টের পক্ষে ইসরায়েলেও ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়া শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও বটে। শুধু তাই নয়, এই দুই দেশ ঘনিষ্ঠ সামরিক মিত্র। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সাহায্য পায়। এই সাহায্যের একটা বড় অংশই খরচ হয় ইসরায়েলের জন্য সামরিক অস্ত্র কেনা এবং মুক্তিকামী ফিলিস্তিনীর দমন ও পীড়নের জন্য। তাছাড়া ইসরায়েলের সাথে রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্সের রয়েছে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সুসম্পর্ক।

 

তবে সাম্প্রতিক ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও চীনের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে এবং হামাসের আকস্মিক হামলার ঘটনায় দুটি দেশই স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এটা আসলে কথার ফুলঝুরি, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোট কথা ফিলিস্তিনের পক্ষে খোলাখুলি সমর্থন যোগানোর মতো একটি বৃহৎ শক্তিও নেই। ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস এক সময় মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। কিন্তু মিশরের সেনাবাহিনী ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যূত করার পর সেখান থেকে হামাস আর কোন সমর্থন পায় না। হামাসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এখন সিরিয়া, ইরান এবং লেবাননের হেযবুল্লাহ গোষ্ঠী। ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্বের আরও অনেক দেশ। কিন্তু এই সহানুভূতি শুধুই কাগুজে, বাস্তবে পরিণত হয় খুবই যৎসামান্য। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এখন যে অস্থিরতা, তার কারণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একছত্র আধিপত্য ও ইসরায়েলের পক্ষে প্রত্যক্ষ অকুণ্ঠ সমর্থন। জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র যখন ফিলিস্তিনের পক্ষে কোন প্রস্তাব নিয়ে যায় তখন তা পাঁচ স্থায়ী সদস্যের বিরোধীতা বা ভেটো ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে যায়।

 

এজন্য জাতিসংঘকে অনেকেই কাগুজে বাঘ বলে অভিহিত করে থাকে কারণ জাতিসংঘের অনেক কার্যাবলী, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পঞ্চভূত বা পাঁচটি স্থায়ী সদস্যদের ভেটো পাওয়ারের কাছে অসহায় ও সীমাবদ্ধ। পাঁচটি স্থায়ী সদস্যদের স্বার্থের বাইরে জাতিসংঘ কার্যকর কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারে না। প্রত্যেকটি স্থায়ী সদস্য পারমাণবিক শক্তির অধিকারী এবং তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছায় বিশ্বে অনেক কিছু সংগঠিত হয়। তাদের অঙ্গুলি নির্দেশে বিশ্বের কূটনীতি ও রাজনীতি আবর্তিত হয়। জাতিসংঘ মূলত বৃহৎ শক্তিধর দেশের চাঁদায় পরিচালিত এবং কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চাঁদা দানকারী দেশগুলোও মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ অধিকাংশ সময় বৃহৎ পাঁচ স্থায়ী সদস্যদের কাছে জিম্মি।

 

সাম্প্রতিককালে ইসরায়েলের সাথে বৈরি সম্পর্ক ছিলো এমন অনেক মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। হামাস বলছে এ ধরনের সম্পর্ক স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় এবং তাদের মূল দাবী ১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধের অবৈধ দখলকৃত জায়গা ইসরায়েলকে ছেড়ে দিতে হবে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন মূলত পরাশক্তি দেশগুলোর একছত্র ইসরায়েল সমর্থন অনেকাংশেই এই সংকটকে টিকিয়ে রেখেছে এবং পরাশক্তিগুলোর বিরোধিতার কারণেই আজও স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি, তাদের কাছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র অনেকটা পুতুল নিয়ে খেলা করার মতো, জাতিসংঘের মূল ব্যর্থতাও এখানেই নিহিত।

 

ব্যাংকার ও কলাম লেখক,
সতিশ সরকার রোড, গেণ্ডারিয়া, ঢাকা

Ads